Conditions for the appointment of a Khalifah

খলীফা নিয়োগের শর্তাবলী 

খলীফা পদে নিয়োগ প্রাপ্তির জন্য একজন ব্যক্তিকে সাতটি অবশ্য পূরণীয় চুক্তিবদ্ধ শর্ত পূরণ করতে হবে। এদের মধ্যে কোন একটির ব্যাত্যয় ঘটলে, খলীফার পদে তার নিয়োগ বাতিল বলে বিবেচিত হবে।

অবশ্য পূরণীয় শর্ত সমূহ: ১.

খলীফা অবশ্যই মুসলিম হবেন।  একজন কাফির বা অবিশ্বাসীকে কোন অবস্থাতেই বাই’আত দেয়া যাবে না। কোন কাফির যদি উম্মাহ্’র নেতা নির্বাচিত হয়ও তবে মুসলিমদের তার আনুগত্য করা শারী’আহ্ সম্মত হবে না। কারণ, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা পবিত্র কুর’আনে বলেন :
 
“আর মুসলিমদের উপর কাফেরদের কর্তৃত্ব করার কোন পথই আল্লাহ  অবশিষ্ট রাখেননি।” [সূরা আন-নিসা : ১৪১]

একজন শাসক যাদেরকে শাসন করেন, পদাধিকার বলে তিনি তাদের উপর কর্তৃত্বশালী হন। উপরোক্ত আয়াতে ব্যবহৃত ‘লান’ (কক্ষণো না) শব্দটি দিয়ে মুসলিমদের উপর কাফিরদের যে কোন প্রকার কতৃর্ত্ব করবার ব্যাপারটি সর্বোতোভাবে নিষিদ্ধ (catergorical prohibition) ঘোষণা করা হয়েছে। মূলতঃ এ আয়াতের মাধ্যমেই কাফিরদের কর্তৃত্ব মেনে নেয়ার ব্যাপারে মুসলিমদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। আবার, অন্য আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এটি স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, যিনি মুসলিমদের বিষয়াদি দেখাশুনার দায়িত্বে নিযুক্ত থাকবেন তাকে অবশ্যই মুসলিম হতে হবে। পবিত্র কুর’আনে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন :

“হে ঈমানদারগণ; তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা কর্তৃত্বশীল (উলীল আমর) তাদের।” [সূরা আন-নিসা : ৫৯]


তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও বলেন,  “তারা যখনই কোন প্রকার জননিরাপত্তা সংক্রান্ত কিংবা ভীতিকর খবর শুনতে পায়, তখনি তা সর্বত্র প্রচার করে দেয় অথচ তারা যদি তা রাসূল ও তাদের উপর কর্তৃত্বশীল ব্যক্তিদের (উলীল আমর) কাছে পৌছে দিত।” [সূরা আন-নিসা : ৮৩]  

উপরোক্ত আয়াতগুলোতে ‘উলীল আমর’ শব্দটি সব সময় মুসলিমদের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়েছে, কখনোই অমুসলিমদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়নি। সুতরাং, এ আয়াতগুলো থেকেও  প্রমাণিত হয় যে যারা মুসলিমদের উপর কর্তৃত্বশীল থাকবেন তাদেরকে অবশ্যই মুসলিম হতে হবে। যেহেতু খলীফা হচ্ছে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বশীল পদ এবং তিনিই অন্যান্যদের কর্তৃত্বশীল পদে নিযুক্ত করবেন, যেমন: তার সহকারীগণ, ওয়ালী, আমীল প্রমুখ, সেহেতু তাকে অবশ্যই মুসলিম হতে হবে।

২. খলীফাকে অবশ্যই পুরুষ হতে হবে।

খলীফাকে অবশ্যই পুরুষ হতে হবে, কোন নারীকে খলীফা নিযুক্ত করা যাবে না। বুখারী থেকে বর্ণিত যে, রাসূল (সাঃ) যখন শুনলেন পারস্যের জনগণ কিসরার কন্যাকে তাদের রাণী হিসেবে নিযুক্ত করেছে, তখন তিনি (সাঃ) বললেন,

 “যারা নারীদেরকে শাসক হিসেবে নিযুক্ত করে তারা কখনওই সফল হবে না।” (সহীহ্ বুখারী, হাদীস নং-৪৪২৫)

উপরোক্ত হাদীসে নারীদের শাসক হিসাবে নিযুক্ত করার সাথে ‘ব্যর্থতা’ শব্দটি যুক্ত করে মূলতঃ রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। এ হাদীসে যারা নারীদের শাসক হিসেবে নিযুক্ত করবে তাদেরকে তিরস্কার করা হয়েছে। অর্থাৎ, তিরস্কারের মাধ্যমে এ হাদীসটি আমাদের এমন একটি নির্দেশ দিচ্ছে যা অকাট্য। যার অর্থ, নারীদের শাসক হিসাবে নিযুক্ত করা নিষিদ্ধ।  আবার, হাদীসের ভাষাটি এমনভাবে এসেছে যে, এখানে যারা তাদের বিষয়াদি দেখাশুনার জন্য নারীদের শাসক হিসাবে নিযুক্ত করবে তাদের সফলতাকে সরাসরি অস্বীকার করেও বিষয়টির অনুমোদন বাতিল করা হয়েছে। সুতরাং, এ কারণেও এ নিষেধাজ্ঞাটি অকাট্য (Decisive)  বলে গণ্য হবে; অর্থাৎ, এদিক থেকেও একজন নারীকে শাসক হিসেবে নিয়োগ দান করা নিষিদ্ধ হিসাবে বিবেচিত হবে। শুধু তাই নয়, নারীদের শাসন সংক্রান্ত যে কোন পদ অলংকৃত করা, সেটি খলীফা কিংবা ওয়ালী বা আমিল, যাই হোক না কেন তা নিষিদ্ধ বলেই বিবেচিত হবে। এর কারণ হচ্ছে, হাদীসের বিষয়বস্তু কিসরার কন্যার রাণী (শাসক) হিসাবে নিয়োগ দেবার সাথে সম্পর্কিত, যা কিনা সরাসরি শাসন-কর্তৃত্বের সাথে জড়িত। এখানে হাদীসের বিষয়বস্তু কিসরার কন্যা হিসাবে তার মর্যাদার সাথে সম্পর্কিত নয়। আবার হাদীসটি অর্থের দিক থেকে ‘আম (সাধারণ) নয়; অর্থাৎ, এক্ষেত্রে বিচারিক কাজে নিযুক্ত হওয়া, শূরা কাউন্সিলের সদস্য হওয়া, শাসককে জবাবদিহি করা কিংবা শাসক নির্বাচন করা ইত্যাদি বিষয়গুলো অন্তর্ভূক্ত হবে না। বরং, এসবই নারীদের জন্য বৈধ, যা পরবর্তীতে নির্ধারিত অধ্যায়গুলোতে আলোচিত হবে।

৩. খলীফাকে অবশ্যই বালেগ হতে হবে।

শিশুকাল অতিক্রম করে  স্বাবালকত্ব অর্জন করার পূর্বে অর্থাৎ, নাবালেগ ব্যক্তিকে খলীফা হিসেবে নিযুক্ত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আবু দাউদ, আলী (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন:

“জবাবদিহিতা তিন ব্যক্তির জন্য নয়: ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না সে জেগে উঠে, বালক য্তক্ষণ না পরিণত হয় এবং উম্মাদ ব্যক্তি য্তক্ষণ না সে মানসিকভাবে সুস্থ হয়।” (সূনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪৩৯৮)

এছাড়া, আলী (রা.) থেকে আরও বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন :

“তিন ব্যক্তির আমলনামায় কিছুই লেখা হয় না: উম্মাদ ব্যক্তি যতক্ষণ না সে সুস্থ হয়, ঘুমন্ত ব্যক্তি য্তক্ষণ না সে জেগে উঠে এবং নাবালেগ যতক্ষণ না সে বালেগ হয়।”

কঅর্থাৎ, যার উপর থেকে কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে সে তার কাজের জন্য দায়ী হবে না। শারী’আহ্ আইনের দৃষ্টিকোন থেকে কোন কাজের জন্য তাকে জবাবদিহিতার সম্মুখীন করা হবে না। এজন্য তাকে খলীফা হিসাবে নিযুক্ত করা কিংবা, শাসনের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত কোন পদে নিযুক্ত করা নিষিদ্ধ। কারণ, নাবালেগ হিসাবে সে তার কোন কাজের জন্য দায়ী নয়। যে ব্যক্তি নিজের কর্মকান্ডের জন্য দায়িত্বশীল নয় তাকে খলীফা পদেও নিযুক্ত করা যাবে না। এ ব্যাপারে আরও দলিল পাওয়া যায় বুখারীর কাছ থেকে যিনি বর্ণনা করেছেন আবু আকীল জাহরা ইবনে মা’বাদ থেকে; তিনি বর্ণনা করেছেন তার দাদা আবদুল্লাহ  ইবনে হিশাম থেকে যিনি রাসূল (সাঃ) এর সময় জীবিত ছিলেন। ইবনে হিশামের মা তাঁকে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর কাছে নিয়ে গেলেন এবং বললেন,

‘হে আল্লাহর রাসূল! তাঁর কাছ থেকে বাই’আত গ্রহণ করুন।’ তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘সে তো ছোট’। অতঃপর তিনি (সাঃ) আবদুল্লাহ ইবনে হিশামের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং দোয়া করলেন।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৭২১০) 

সুতরাং, হুকুম শারী’আহ্’র দৃষ্টিকোন থেকে, নাবালেগের বাই’আত যেহেতু গ্রহণযোগ্য নয় এবং নাবালেগ ব্যক্তি খলীফাকে বাই’আত দিতে সক্ষম নয়, সেহেতু তার নিজের পক্ষে খলীফা হওয়াও সম্ভবপর নয়।

৪. খলীফাকে সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হতে হবে।

উম্মাদ বা অপ্রকৃতস্থ ব্যক্তিকে খলীফা হিসাবে নিয়োগ দেয়া নিষিদ্ধ। কারণ রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “তিন ব্যক্তির আমল নামায় কিছুই লেখা হয় না: উম্মাদ ব্যক্তি যতক্ষণ না সে সুস্থ হয়...”। এ হাদীসের মাধ্যমেই এ ব্যাপারে ইঙ্গিত করা হয়েছে। অপ্রকৃতস্থ ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত জবাবদিহিতার আওতায় আসবে না যতক্ষণ সে মানসিকভাবে সুস্থ হয়। কারণ, মানসিক সুস্থতা যে কোন দায়িত্ব পালন করার পূর্বশর্ত। খলীফা শারী’আহ্ আইনকে কার্যকর করেন এবং সেইসাথে, শারী’আহ্ প্রদত্ত সকল দায়িত্ব পালন করেন। সে কারণে একজন অপ্রকৃতস্থ খলীফা থাকা বৈধ নয়। কারণ, একজন অপ্রকৃতস্থ ব্যক্তি নিজের কাজের ব্যাপারেই দায়িত্বশীল নয়, সুতরাং বৃহত্তর যুক্তিতে (by greater reason) সে ব্যক্তি কিভাবে উম্মাহ্’র ব্যাপারে দায়িত্বশীল হবে?

৫. খলীফা ন্যায় বিচারক হবেন।

কোন ফাসিক ব্যক্তি- যে নির্ভরযোগ্য নয় সে খলীফা হতে পারবে না। সত্যনিষ্ঠতা ও দৃঢ় নৈতিক গুণাবলী খলীফা হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্তির পূর্বশর্ত ও এ দায়িত্ব পালনের ধারাবাহিকতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন যেন সাক্ষ্যদানকারী ব্যক্তি অবশ্যই সৎ হয়। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন :

“আর এমন দু’জন লোককে সাক্ষী বানাবে যারা তোমাদের মাঝে সত্যনিষ্ঠ হবে।” [সূরা আত-তালাক : ২]

যেহেতু সাক্ষ্যদানকারীদের সত্যনিষ্ঠ হতে হবে, সেহেতু যিনি ঐসব সাক্ষ্য দানকারীদের উপর কর্তৃত্ব করবেন এবং যিনি সর্বোচ্চ পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবেন, বৃহত্তর যুক্তিতে(By greater reason) তাকে অবশ্যই সৎ হতে হবে।

৬. খলীফা অবশ্যই আযাদ বা মুক্ত মানুষ হতে হবে।

যেহেতু একজন ক্রীতদাস সম্পূর্ণভাবে তার প্রভূর নিয়ন্ত্রণাধীন এবং সে নিজেই তার নিজের ব্যাপারে কোনরকম সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম, সেহেতু তার পক্ষে জনগণের বিষয়াবলী দেখাশুনা করা কিংবা তার উপর তাদের শাসনভার অর্পণ করা সম্ভব নয়।

৭. খিলাফতের গুরুদায়িত্ব পালনে খলীফাকে অবশ্যই স¶ম হতে হবে।

কোন ব্যক্তি যে কোন কারণেই হোক না কেন, যদি দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়, তবে বাই’আতের চুক্তি অনুসারে পবিত্র কুর’আন ও সুন্নাহ্ অনুযায়ী সে মানুষের বিষয়াদি দেখাশুনার দায়িত্ব নিতে পারবে না। কারণ, উম্মাহ্’র বিষয়াদি দেখাশুনা করার জন্যই খলীফাকে বাই’আত দেয়া হয়। খলীফার দায়িত্ব পালনে অযোগ্যতা আছে কিনা কিংবা অযোগ্যতা থাকলে তা কি ধরনের, তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব মাযালিম আদালতের (The Court of Unjust Acts।

পছন্দনীয় শর্তাবলী: 

উপরে উল্লেখিত শর্তাবলী একজন খলীফা নিযুক্ত হবার জন্য আবশ্যিক। এ সাতটি বাদে বাকী কোন শর্তই খলীফা নিযুক্ত হবার জন্য বাধ্যতামূলক নয়। এছাড়া, কিছু শর্তাবলী রয়েছে যেগুলো সহীহ্ দলিল প্রমাণের মাধ্যমে যদি জরুরী প্রমাণিত হয় তাহলে এগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে, তবে সেগুলো হবে পছন্দনীয় শর্তাবলী। যদি কোন নির্দেশ অকাট্য (Decisive) বলে প্রমাণিত হয় তাহলে সেটাকে আবশ্যিক শর্তাবলীর আওতায় নেয়া হবে। আর যদি দলিলের ভিত্তিতে সেটি অকাট্য বা চূড়ান্ত (Decisive) বলে প্রমাণিত না হয় তাহলে সে শর্তটি পছন্দনীয় বলে পরিগণিত হবে। এখন পর্যন্ত উল্লেখিত সাতটি আবশ্যিক শর্তাবলী ব্যতীত আর কোন গুণাবলী আবশ্যিক বলে প্রমাণিত হয়নি। সে কারণে এই সাতটিই খলীফা নিয়োগের জন্য আবশ্যিক শর্তাবলী হিসেবে বিবেচিত হবে। আর, সহীহ্ দলিলের মাধ্যমে প্রমাণিত বাকী শর্তাবলী শুধুমাত্র পছন্দনীয় শর্তাবলী বলেই বিবেচিত হবে। যেমন: খলীফাকে কুরাই’শ বংশোদ্ভুত, মুজতাহিদ কিংবা অস্ত্র চালনায় পারদর্শী হতে হবে ইত্যাদি। তবে, এগুলোর কোনটিই আবশ্যিক হিসাবে বিবেচনা করার মতো অকাট্য দলিল নেই।
Powered by Blogger.